কানাইঘাট প্রতিনিধি : সিলেটের কানাইঘাটের সীমান্তবর্তী লোভাছড়া পাথর কোয়ারীতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দীর্ঘদিন থেকে পড়ে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক জব্দকৃত পাথর চুরির হিড়িক পড়েছে। পাথর চুরি বন্ধ ও জব্দকৃত পাথরের সুরাহা করা না হলে সরকার কোটি কোটি টাকার রয়্যেলিটি হারাতে পারে। পাথর চুরি বন্ধে এবং ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে গত মঙ্গলবার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে কোয়ারী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা।
জানা যায়, ২০২০ সালে লোভাছড়া পাথর কোয়ারী থেকে সব ধরনের পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় কোয়ারীর লীজের মেয়াদ শেষ হওয়ার কারনে পরিবেশ অধিদপ্তর কোয়ারীর দুই পারে থাকা প্রায় ১ কোটি ৫ লক্ষ ঘনফুট পাথর জব্দ করে। পাথরের মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতে একাধিক রীট মামলা হয়। তারপরও জব্দকৃত পাথরের কোন সুরাহা হয়নি। যার কারনে দীর্ঘদিন থেকে পড়ে থাকা পাথর দিন দিন চুরি হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর কোয়ারীতে থাকা জব্দকৃত পাথর কয়েকদিন ব্যাপক হারে চুরি করে পাচার শুরু হলে স্থানীয় প্রশাসনের বাঁধায় মধ্যখানে তা বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু মাস খানেক আগ থেকে শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ায় আবারো অবৈধভাবে কোয়ারী থেকে বারকি নৌকা দিয়ে একটি চক্র পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি জব্দকৃত পাথর ট্রাক ও ট্র্যাক্টর দিয়ে বিভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করে এবং লোভা-সুরমা নদী দিয়ে নৌকা যোগে বিভিন্ন এলাকায় পাচার শুরু হয়েছে। স্থানীয় সচেতন মহল জানিয়েছেন, কোয়ারীর পাশে লোভাছড়া বিজিবি ক্যাম্পের অবস্থান থাকা সত্তে¡ও এবং ঐ এলাকায় বিজিবি ও পুলিশের টহল থাকা সত্ত্বেও পাথর পাচার ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি না থাকার কারনে বর্তমানে কোয়ারীতে থাকা জব্দকৃত পাথর ট্রাক, ট্র্যাক্টর ও বারকি নৌকা দিয়ে চুরির ঘটনা বাড়ছে এবং অবৈধভাবে কোয়ারী থেকে একটি চক্র পাথর উত্তোলন করে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর বিক্রি করে আসছে। এতে করে সরকার কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
গত মঙ্গলবার উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের এলাকাবাসীর পক্ষে কোয়ারীতে থাকা জব্দকৃত পাথর পাচার, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন সহ থানা পুলিশের নাম ভাঙিয়ে পাথরবাহী ট্রাক ও নৌকা থেকে চাঁদা উত্তোলনের সাথে জড়িত স্থানীয় বাখালছড়া গ্রামের আব্দুল মন্নানের পুত্র কিবরিয়া, ডেয়াটিলা গ্রামের সানু মিয়ার পুত্র দেলোয়ার হোসেন ও উজানফৌদ গ্রামের ইফজালুর রহমান সহ অজ্ঞাতনামা ১৫/১৬ জনকে বিবাদী করে নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।
দরখাস্তকারী স্থানীয় বিএনপি নেতা জাকারিয়া সিদ্দিকী লিটন, নুরুল আম্বিয়া, সুলতান আহমদ সহ আরো বেশ কয়েকজন স্বাক্ষরিত দরখাস্তে উল্লেখ করেন, ৫ই আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর বিবাদীগণের নেতৃত্বে তাদের সহযোগীরা পাথর কোয়ারীতে মজুদকৃত জব্দকৃত পাথর ট্র্যাক্টর দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পাচার ও বিক্রি সহ তাদের লোকজন দ্বারা কোয়ারী থেকে অবৈধ ভাবে পাথর উত্তোলন করে আসছে। তারা এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় কারো তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে জব্দকৃত পাথর ও কোয়ারী থেকে অবৈধ ভাবে হাজার হাজার ঘনফুট পাথর উত্তোলন করে রাতে এবং দিনের বেলায় সুযোগ বুঝে স্থানীয় উজানফৌদ গ্রামের দিঘীরপাড় সুরমা নদীর খেয়াঘাটে, আব্দুরমুখ বাজার, মমতাজগঞ্জ বাজারের পূর্ব পাশের্^ সুরমা নদীর ঘাটের বিভিন্ন এলাকায় এবং জকিগঞ্জ উপজেলার আটগ্রাম বাজার, দিঘীরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের খুলুরমাটি, সড়কের বাজার, সাতবাঁক ইউনিয়নের চরিপাড়া, চিন্তারবাজার ও লোভারমুখ বাজারে ট্র্যাক্টর ও নৌকা দিয়ে পাথর মজুদ করে বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে আসছে। অবৈধভাবে জব্দকৃত পাথর এবং কোয়ারী থেকে পাথর উত্তোলন করে পরিবহনের ঘটনায় এলাকার লোকজন তাদের বাঁধা নিষেধ দিলে তারা থানা পুলিশের নাম ব্যবহার করে চুক্তির মাধ্যমে পাথর পরিবহন করছে বলে জানায়। এমনকি পাথরবাহী প্রতিটি ট্র্যাক্টর থেকে ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকা এবং বারকি নৌকা থেকে ৫/৭ শ’ টাকা প্রতিদিন প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করছে।
দরখাস্তে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ইতিমধ্যে থানা পুলিশ ও প্রশাসনের নাম ভাঙিয়ে বিবাদীগণ লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা আদায় ও কয়েক কোটি টাকার পাথর বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি সহ বড় ধরনের ক্ষতিসাধন করছে। কোয়ারীতে জব্দকৃত ১ কোটি ঘনফুটের উপরে পাথর মজুদ ছিল। কিন্তু জব্দকৃত এসব পাথর অবাধে পাচার হওয়ায় বর্তমানে তা অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে জানান। এছাড়া কোয়ারী থেকে জব্দকৃত পাথর সুরইঘাট, বড়বন্দ এলাকা দিয়ে রাত্রের বেলা পরিবহন বেড়ে যাওয়ার কারনে পাথর চুরি বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন নুনগাং এর উপর মাটির বাঁধ সরু করলে একটি চক্র আবারো বড় করে বাঁধ দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে লোভাছড়া পাথর কোয়ারীতে থাকা জব্দকৃত পাথর পাচার এবং উত্তোলন করে নদীপথে বারকি নৌকা দিয়ে পাথর চুরির সাথে জড়িত রয়েছেন, দিঘীরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের খুলুরমাটি গ্রামের সুবহান আলীর ছেলে যুবলীগ নেতা আব্দুল কাদির, একই গ্রামের আব্দুল খালিক, কাজিরগ্রামের আব্দুল মুমিন, সাতবাঁক ইউপি বিএনপি নেতা ইউপি সদস্য শায়িকুর রহমান, আওয়ামীলীগ কর্মী ইউপি সদস্য মঈনুল হক, ভাল্লুকমারা গ্রামের মন্তাজ আলী, ভাটিবারাপৈত গ্রামের বিহারী রায়ের ছেলে রঞ্জন রায় সহ কোয়ারী এলাকার আরো একাধিক ব্যক্তি। তারমধ্যে আব্দুল কাদির থানা পুলিশের নামে পাথরবাহী বারকি নৌকা থেকে এবং সড়কের বাজার সহ আশপাশ এলাকায় পাচারকৃত পাথর ক্রাশার মেশিন দিয়ে ভেঙে বিক্রি করার সাথে জড়িতদের কাছ থেকে হাজার থেকে পনের’শ টাকা চাঁদা আদায় করে থাকে বলে স্থানীয় অনেকে জানিয়েছেন। মুলাগুল এলাকায় যুবদল কর্মী ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে মাসুয়ারা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে। তবে গত ২ দিন থেকে থানা পুলিশ ও প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর কারনে পাথর পাচার অনেকটা কমে এসেছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরিনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, কোয়ারী থেকে জব্দকৃত পাথর চুরি এবং কোয়ারী থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উপজেলা প্রশাসন দু’টি ক্রাশার মেশিন গুড়িয়ে দেয়া সহ চুরি হওয়া পাথর জব্দ করা হয়েছে। পাথর চুরি বন্ধে প্রশাসনের অভিযান আরো জোরদার করা হবে বলে জানান।
কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল বলেন, বর্তমানে থানায় পুলিশ অফিসারের সংখ্যা অনেকটা কম রয়েছে, তারপরও কোয়ারী এলাকায় জব্দকৃত পাথর যাতে করে চুরি না হয় এবং কেউ যাতে পাথর উত্তোলন করতে না পারে এজন্য পুলিশ সার্বক্ষণিক সেখানে রয়েছে, পাথর জব্দ করা হচ্ছে। পুলিশের নামে টাকা উত্তোলনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।